Biography of UTPAL DEY
ছোটবেলাটা শুরু হয়েছিল ঠিক এভাবে ১৯ ৮৭ সাল জুন মাসের ৪ তারিখ। কলকাতা বাগুইহাটি কেষ্টপুরে। খুবই দরিদ্র এক পরিবারে, বাবা ছিলেন গাড়ির ড্রাইভার মা ঘরে কর্মরত, সাথে বড় দিদি, দাদা ছোট আমি।আমার ডাকনামও ছিল ছোট, বড় হওয়ার পরে শুনি যখন আমার ৬ মাস বয়স ছিল পোলিও না খাওয়ানোর কারণে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমার লোয়ার পরসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে সময় এতটাই অভাবের তাড়না ছিল যে পোলিও খাওয়ানোর সেভাবে চল ছিল না। যে কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যাই হোক আস্তে আস্তে যখন বড় হলাম সব কিছু বুঝতে একটু কষ্ট হচ্ছিল।
স্কুলে ভর্তি হলাম মা কোলে করে স্কুলে দিয়ে আসতো, ক্লাস এইট অব্দি মায়ের কোলে স্কুলে গেছি বন্ধু-বান্ধব হয়েছে তারা নিয়ে যেত। বাড়িতে কেউ আসলে সেও দু-একবার দিয়ে আসতো নিয়ে আসার সময় সমস্যা হতো খুব, এসব করে কোন মতে মাধ্যমিকের পরীক্ষায় অব্দি পৌছালাম তখনো আর্থিক সমস্যা মেটেনি,তিন ভাইয়ের পড়াশোনা খাওয়া-দাওয়া সব সামলে উঠতে না পেরে প্রথম বছর মাধ্যমিক দেওয়া হল না।
দ্বিতীয় বছর পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলাম এইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে নববারাকপুর আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে ভর্তি হলাম ক্লাস নাইন এ থাকাকালীন ক্লাস রুমে বসে একা একা গাইতাম সাথে কিছু বন্ধুরা সঙ্গদিত বাজানোর জন্য এছাড়া ক্লাস সেভেন অব্দি সেভাবে স্কুলে যেতে পারতাম না।
আসা-যাওয়ার সমস্যা হতো খুব, তাই অধিকাংশ সময় বাড়িতে কাটাতে হতো কোনো বন্ধু এসে স্কুলে নিয়ে যেত কোন কোন দিন বাকি সময়টা ঘরে বসে কিছুতেই কাটতো না। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না বললেই চলে। তাই এতটা আপডেট ছিল না সবকিছু।
আর একটা ছোট ঘটনা বলি ঘরের পাশে একটা পার্ক ছিল একটা মাঠ ছিল খুব ইচ্ছে করতো খেলতে যেতে যেতামও, তাই একদিন সন্ধ্যেবেলা মাঠে গিয়ে ফেরার সময় কোন বন্ধু-বান্ধব কেউ ছিল না আমি আর ফিরে আসতে পারছিলাম না কারণ তখন আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না খুব কষ্ট হয়েছিল ভগবানকে চোখের জল ফেলতে ফেলতে অনেক আজেবাজে কথা বলেছিলাম তুমি কেন আমার সঙ্গে এমনটা করলে, খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন, তারপর খেলতেও কম যেতাম কোন বন্ধু এসে নিয়ে গেলে যেতাম না হয় যেতাম না এই ঘটনার পর থেকে আমি অদ্ভুত এক জিনিস লক্ষ্য করেছি গান গাওয়া, হঠাৎ আমার মধ্যে কিভাবে সুরের জন্ম হলো।ঘরে বসে একা একাই গান গাইতাম। চিৎকার করে করে মা আমাকে অনেক সাহস দিত।
আস্তে আস্তে পাড়ার লোকজন রাস্তা থেকে যেত আর বলতো তুই ভালো গান করিস এরকম ভাবে বছর দুই তিনে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন পাড়ায় ফাংশন হল শিল্পী আসতে দেরি হয়েছিল পাড়ার সকলে জানত আমি চিৎকার করে গান করি তাই আমাকে তারা বলল তুই কি আজ মঞ্চে গাইতে পারবি? তার আগে বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোড়ে একদিন বসে ছিলাম পাশে ছিল আমার গুরুজীর বাড়ি, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী রিয়াজ করছিলেন আমি অবিকল তার গান জোরে জোরে নকল করেছিলাম। উনি সেটা শুনে কিছুদিন পর আমাকে ডেকে বললো আগের দিন আমাকে যেভাবে ভেঙালি আবার করে দেখাতে পারবি আমি প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর উনাকে শোনালাম যেভাবে উনি গাইছিলেন। তখন তিনি আমাকে বললেন তুই কি গান শিখবি? আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম বছর খানেক ওনার কাছে তালিম নিয়েছি তার জন্য উনি কোন পারিশ্রমিক নেয়নি।
সিডি ক্যাসেট ট্রাক চালিয়ে আমি গান করা শুরু করলাম। প্রায় এক ঘন্টা গাইলাম পাড়ার ফাংশানে, সবাই খুব বাহবা দিল এর আগে আমি আরেক জায়গায় গান গেয়েছি, একদম প্রথম দিন আমার ছোটবেলার ব্যান্ডের বন্ধু অভিজিতের বাড়ির পাড়াতে স্কুলের বন্ধুরা আমায় ধরে মঞ্চে তুলে দিয়েছিল আমি তিনটে গান গেয়েছি সবাই খুব ভালোবাসা দিয়েছিল তাই সাহস পেয়েছিলাম পাড়ায় গান করার এই শুরু হলো আমার গানের জীবন।
সত্যি কথা বলতে আমার জীবনে আমার বন্ধুদের ও আমার মায়ের অনেক অবদান রয়েছে। মা আমার সাহস দিত তুই গানই করবি, এবং বন্ধুরা আমাকে খুব ভালোবাসতো আমি তাদের সঙ্গে খুব আনন্দ করতাম তাই, তার মধ্যে অন্যতম অভিজিৎ রাহুল হাবু বিকু, গপু সোমনাথ পাপ্পু সন্তু লালটু টেপা, পাড়ার মঞ্চে গান গাওয়ার পর একটু একটু করে আমাকে সবাই এদিক ওদিক গান করতে ডাকতো বিনা পারিশ্রমিকে গাইতাম। স্কুল থেকে আমার কিছু মিউজিশিয়ান বন্ধু জোগাড় হল।
অভিজিৎ রাহুল হাবু বিকু আমরা একটা ভাঙা ঘরে বসে প্র্যাকটিস করতাম আস্তে আস্তে একটা ছোট ব্যান্ড বানিয়েছিলাম।এরপর কলেজে যাওয়ার সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে গান করার সুযোগ পেলাম কলেজে।
গাইলাম সবাই অনেক ভালোবাসা দিল আরো নাম ছড়িয়ে পড়লো আমার এলাকায় আমি এবার একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম গান নিয়ে পড়াশোনা করব।তাই আমার বন্ধু সঞ্জীবের সাথে বহু কষ্ট করে রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হলাম। কিন্তু সেখানেও আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলাম না। মাসখানেক যাওয়ার পর আমি কলেজটি ছাড়তে বাধ্য হলাম কারণ কলেজ গেট থেকে ভেতরে যেতে হতো অনেকটা হেঁটে,,,, আমার কাছে কোন গাড়ি বা যাতায়াত করার কিছু ছিল না বাবা যে গাড়িটা চালাত সে গাড়িটা করে সম্ভব ছিল না আমাকে সেই কলেজে দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসার, কারণ সেটা আমাদের সংসারের চালানোর কাজে ব্যবহার হতো।
আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম, কিছুদিন এভাবে যাওয়ার পর আমার জীবনে এলো আমার স্ত্রী আমরা কথা বলতে লাগলাম অনবরত ফোনে সম্পর্ক গভীর হলো অনেক কিন্তু আমার কাছে কোন হাতে কাজ নেই। প্রথম প্রেম আকৃষ্ট হলাম অনেক সারাদিন রাত, একটা ছোট্ট ফোন জোগাড় করে তার সাথে কথা বলতাম, এয়ারসেল কোম্পানি ১১ টাকায় সারাদিন কথা বলতে দিত তখন। যেভাবে হোক জোগাড় করে চালিয়ে নিতাম এভাবে ছয় বছর চালানোর পর সে আমাকে সাহস দিল তোমাকে এবার কাজে নাবতে হবে। ছোট করে বলি।
আমি আমার পাড়ার এক দাদাকে বলে সিঙ্গিং বারে যুক্ত হলাম রোজ আমি সেখানে গান গাইতে যেতাম আস্তে আস্তে আমার হাতে পয়সা আসতে লাগলো, আমার মা ঘরে ব্লাউজ সেলাই করতেন সেখান থেকে জমিয়ে জমিয়ে কিছু টাকা রেখেছিলেন আমি মাকে বললাম আমি একটা গাড়ি কিনব স্কুটি, মা কোন কথা না ভেবেই আমাকে পুরো টাকাটা দিয়ে দিল দশ হাজার টাকা। আমি বন্ধুদের সাইকেলে ঘুরতাম আর ফলো করতাম তারা কিভাবে সাইকেল চালায়। আমি ভাবলাম এমন কিছু করতে হবে যাতে আমার হাত দিয়ে আমি সব করতে পারবো চালানোর বুদ্ধি দিল আমার পাড়ার এক দাদা। আমি দুম করে কিনে নিয়ে চলে এলাম গাড়ি মায়ের সেই জমানো টাকা দিয়ে প্রথম প্রথম বন্ধুরা এসে স্কুটি করে আমায় নিয়ে যেত কিন্তু আমি ভাবলাম তারা কতদিন আমার সাথে থাকবে। তারা আসলে আমি আমার কাজে বেরোবো না হলে বেরোতে পারবো না?তাই একদিন সাহস করে নিজে বেরিয়ে পড়লাম পড়ে গেছিলাম উঠে আবার চালানো শিখেছি এখন আমি খুব ভালো গাড়ি চালাতে পারি। এই গাড়ি কেনার পর আমার জীবনটা বদলে গেল আমি যেখানে খুশি যেতে পারতাম যেমন ভাবে খুশি নিজেকে চালনা করতে পারতাম আমি আস্তে আস্তে কাজের মধ্যেI ইনভলব হলাম বারে.. আমার সাথে অনেক মানুষের পরিচয় হলো তারা আমাকে ছোট ছোট অনুষ্ঠান দিতে লাগলো আমার পরিচিতি আরও বেড়ে গেল আমি সুফি গান গাইতে খুব ভালবাসতাম ব্যান্ড বানিয়েছিলাম সুফি, আমার নাম বিভিন্ন জায়গায় ছড়াতে লাগলো, এবার আমি একটু নিজের পায়ে দাঁড়ালাম কিছু পয়সাও জমে গিয়েছিল আমার কাছে.হঠাৎ আমার প্রেমিকা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল আমি রাজি হয়ে গেলাম বিয়ে করে নিলাম.
এক বছর পর আমাদের একটি কন্যা সন্তান হল, তার আট বছর পর আরেকটি পুত্র সন্তান, শুরু থেকেই ভাবতাম বিভিন্ন রিয়ালিটি শো তে গিয়ে নিজে জয়ী হবো, গিয়েও ছিলাম কিন্তু সে জায়গাগুলোতে শেষমেষ একটাই জিনিস বুঝলাম আমার সিমপ্যাথি টাকে ভেঙে মানুষকে দেখিয়ে তারা নিজের নাম অর্জন করা ছাড়া আমাকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, তাই কোন চ্যানেলের নাম বলছি না তবে টিভিতেও আমি দু-একবার অনুষ্ঠান করেছি, যাই হোক এখন আমি অনেক ভালো আছি গানের মধ্যে দিয়ে আমার পুরো ফ্যামিলি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে বাহবা দেন যে আমি আমাকে চেঞ্জ করে ফেলেছি এবং কিছু করে দেখিয়েছি আর এই সবটাই আমার মা বন্ধু-বান্ধব পারিপার্শ্বিক সংগীত ভক্তরা আমার স্ত্রী এবং আমার সঙ্গীত গুরুজীর জন্য🙏